মানুষের হৃদয় ছোঁয়ে যায় এরূপ ভালো গল্প বলতে পারি না। পুরুষ আর নারী কণ্ঠস্বরের মিশ্রণে গলার আওয়াজ শুনে আপনারা হয়তো মুচকি হাসবেন। অনেকে বিরক্তি বোধ করে উঠে যেতে চাবেন। তবে আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য দাঁত চেপে কপাল ভাঁজ করে ভেংচি মেরে বাহ চমৎকার হচ্ছে বলবেন। মনে মনে এইও বলবেন, কাকে ময়ূরের পাখ লাগাতে চায়।
আমি বোকা হলেও এতোটা না। অন্তত এই বুঝটুকু আমার আছে। বুঝের উৎপত্তি হয়েছিল ছাত্র জীবনেই। কলেজের ক্লাস শেষে এক বান্ধবীর সাথে বাড়ি ফিরছিলাম। পথে বান্ধবীর অনুরোধে একটি গান গাই। বান্ধবী অনুরোধ কেন রেখেছিলাম তৎকালীন সময়ে মগজে না ঢুকলেও কয়েকদিন আগে অফিসে তা অনুধাবন করতে পারি। আমার এক সহকর্মীকে বস বললেন, বউয়ের ভাই। আহা তার আনন্দের যে সীমা নাই। বস বলেছে ! এ যেন বিশাল প্রশংসা। কি বললেন, কেন বললেন ? সেদিকে কোন হুশ নেই।
তাই আমিও আনন্দ চিত্তে সেদিন গাইছিলাম, ‘যদি মানুষের মত মানুষ হতে চাও ভালোবাসে মানুষকে। আলো ভালবাস এই দেশ, এই মাটিকে।’
গান গেয়ে শেষ করতে না করতেই দেখলাম এক বন্দুকধারী কপাল থাপরায়ে আহাজারি করছে। লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই আমার গানটা বুঝি আপনার মনে ধরেছে ? আরো একটি শুনাবো?
উত্তরে লোকটি বলল, ভাই আমি একটি পাখিকে গুলি করলে সে অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে যায়। আমি ছুটে গিয়ে পাখিটি কুড়ায়ে নিচ্ছিলাম। তখনই আপনার গান শুনে তার জ্ঞান ফিরে আসে এবং উড়ে চলে যায়। আর গান গেতে হবেনা। এতে হয়তো আমার থলের জবাইকৃত পাখিগুলো জীবিত হয়ে পালিয়ে যাবে।
লোকটির এরূপ আহাম্মকি প্রশংসা শুনে বান্ধবীর নিকট জানতে চাইছিলাম, শোন পাগলের কথা। প্রতিভার কদর এরা বুঝেনা। ঘুরে তাকায়ে দেখি বান্ধবীও নেই। সে অনেক আগেই মান ইজ্জত নিয়ে কেটে পড়েছে।
তাই গল্প বলতে আমারও সংকোচ বোধ হচ্ছে। তারপরেও যেহেতু দাড়িয়েছি, সেহেতু বলি।
দেহের গঠন আর রুপের ধরণ দেখে অনেকে আমাকে চেংটাকি বলত। ছোট বেলা মাইঞ্জা মেরে প্যান্ট শার্ট পড়েছিলাম। আমার কোমরের করুণদশা দেখে দাদী বললেন, আমাগো নোয়াদ্দারে মাইঞ্জা মারা ছাড়াই প্রিন্সের মত লাগে। ইহা শুনে আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। সেই হতে প্রিন্সের উপাধি ধরে রাখার জন্য আর মাইঞ্জা মারিনা।
অন্যদিকে বাবা বলতেন, গোবর গনেশ। বিএ পাশ করেছিস জমির দলিল টাও পড়তে পারিস না।
পরিবারের বড় ছেলে বিধায মা প্রায়ই আমাকে দিয়ে মেয়েলি কাজ করাতেন। একদিন মাটির কলস দিয়া বললেন পুকুর হতে পানি আনতে। মায়ের আদেশ মত কলস ভরে পানি নিয়ে পুকুর পাড় দিয়ে উঠে আসছিলাম। অসতর্কতা বশতঃ পা পিছলে পড়ে যাই। এতে উত্তম মধ্যম যা খেয়েছিলাম তা প্রতি অমাবস্যায় ছাড়া আঁচ করতে না পারলেও মায়ের দেয়া উপাধি ঠিকই সর্বদা মনে পড়ে। “কাইল্লা তোরে পেটে না ধরে যদি একটি বকরী পালতাম তাতেও দুধ পাওয়া যেত”। বড় হয়ে কি করে খাবি? রূপটাও মাশাআল্লাহ পতিলার কালি। কোন মাইয়া তোর দিকে ভুলেও তাকাবেনা।
মায়ের সেই কথাগুলো আমার অন্তরে বিধে যায়। তাই তখন থেকেই মেয়ে পটানোর কৌশলগুলো প্রতিবেশী বড় ভাই বোনদের প্রেমপত্র আদান প্রদানের দায়িত্ব পালন করতে করতে রপ্ত করেছিলাম। সেখান হতে কিছু অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়ে শিক্ষিত বেকুব মেয়েকে পটায়ে ফেললাম। যার নাম কোহিনুর আক্তার (লিপি)।
প্রেমে পড়লে মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চোখে কালো গ্লাস পড়ে দিনকে অন্ধকার বানায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমার স্ত্রী। যারা তাকে দেখেছেন তারা হয়তো মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলেন,‘কিসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি’। তবে মা সন্তুষ্ট। অতীতে আমাকে নিয়ে যা বলতেন সেসব নাকি তাঁর আশির্বাদ ছিল। মা বলেন, আমি জানতাম তুই একদিন বড় হবি। মা বাবাকি সন্তানের অমঙ্গল চাইতে পারে ? সন্তান অন্যের চোখে নাকছিটকানিমূলক বা এর চেয়েও তুচ্ছ হতে পারে কিন্তু মা বাবার চোখে সে অমূল্য রতন। আর তুইতো ঘোর অন্ধকারে আমাদের প্রদীপ। তবে তখন বলতামনা, যদি কারো নজর লেগে যায় !
আমার দৃষ্টিতে পড়ছে আপনারা শুরু হতেই মিটি মিটি হাসছেন। সে জন্য গল্প বলতে না পারার অপারগতা প্রথমেই প্রকাশ করেছিলাম। তবে আপনাদের হাসির কারণ সম্পূর্ণ অনুমান করতে না পারলেও বছর তিনেক আগের এক ঘটনা মনে পড়ায় আমারও হাসি পাচ্ছে।
আমি কবি কিনা! তাই নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমন না করলে কবিতা লেখায় নতুনত্ব আনতে পারিনা। বিধায় যখন তখন যেখানে সেখানে ছুটে যেতাম। কবে ফিরতাম তার কোন হদিস থাকত না।
আমি যে গোবর গণেশ ও ঘটিরাম, বিবাহের প্রথম দিনই বধূটি টের পেয়েছিল। এখনও তাই। যদিও মুখে প্রকাশ করে না। আমিও তার মনোভাব বুঝতে পারতামনা, যদিনা তার চাচাতো বোনের সাথে একান্ত আলাপের কিঞ্চিত না শুনতাম। তাকে বলতে শুনি, এই বেডার লগে বিয়া না বইয়া যদি মুরগী পালতাম তাতেও লাভ ছিল। জীবনটা অতিষ্ট হয়ে গেছে।
তার বক্তব্য মোটেও অমূলক ছিলনা। কেননা আমি যখন ভ্রমনে বের হতাম তখন, ঘরে কি আছে? স্ত্রী সন্তানেরা কি খাবে ? তার কোন খোঁজ খবর রাখতাম না। আমি এতোটাই অলস ও উদাসীন ছিলাম যতটা নিশ্চিন্তপুরের লোকজন।
নিশ্চিন্তপুরের এক ভিক্ষুক বেশ কয়েক বছর যাবৎ শান্তিনগরে বসবাস করে আপন পেশা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একদিন ভিক্ষা করতে করতে প্রায় সন্ধা হয়ে যায়। সারাদিন অনাহারে ছিলেন বিধায় এক বাসায় কিছু খাবার চায়। তারা খেতে দেয়। খাওয়া শেষে তাদের বাড়িতে রাতটা থেকে যেতে পারবে কিনা জানতে চান। তাদের বাড়িতে মহিলা মেহমান আছে। তাই থাকা যাবেনা বলে তারা জানান।
ভিক্ষুক হাটতে হাটতে অন্য একটি বাড়িতে যান। সেখানে ঘরে টোকা দিলে এক ভদ্র মহিলা দরজা খোলেন এবং লোকটি কি চায় তা জানতে চান। ভিক্ষুক বিনয় স্বরে জানতে চাইলেন, আপনাদের বাড়িতেকি কোন মহিলা মেহমান আছে ? এরূপ বিব্রতকর প্রশ্ন শোনে মহিলা বললেন, কেন ? ভিক্ষুক জানালেন, না মানি বলছিলাম, একটু শুতাম !
ব্যস। এলাবাসী ধরে গণধোলাই দেয় সেই সঙ্গে জানতে চায় ঘরে তোর বউ নেই ?
ভিক্ষুক জানায় আছে। তবে বছর পার হয়ে যাচ্ছে বাড়ি যাইনা।
এতে এলাকার যুবকরা তোর বউকে উত্ত্যক্ত করেনা ?
এর উত্তরে ভিক্ষুক জানায়, তারা এতোটাই অলস যে আমি কবে ফিরব সেই অপেক্ষায় থাকে। তাই ভিক্ষুক কোন দুশ্চিন্তা করেননা।
ভিক্ষুকের চেয়ে আমার কর্মকান্ড আরো কয়েক ধাপ নিচে।
ভ্রমন শেষে প্রায় দুই সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরছিলাম। ফেরার পথে আমার কবিতার এক ভক্তের সাথে দেখা। সে আমার কবিতার অনাকাঙ্খিত ভালো প্রশংাসা করলে আমি মুগ্ধ হই এবং অতি উল্যাসে তাকে বাড়ি নিয়ে আসছিলাম। তখন গভীর রাত।
আসার সময় মনে হল ভক্তকে যে সঙ্গে নিচ্ছি ঘরে যদি কিছু না থাকে ! তাহলে সে খাবে কি ? যদিও আমার নিকট কোন টাকা পয়সা ছিলনা তথাপিও পরিচিত দোকান হতে বাকিতে একটি ডিম এবং আধা সের চাল কিনে রওয়ানা হলাম।
বাড়িতে পৌঁছে দেখি স্ত্রী সন্তানেরা ঘুমায় নি। মনে মনে খুশি হলাম। ফেরার পথে সংশয়ে ছিলাম, স্ত্রী ঘুমন্ত থাকলে জাগ্রত করে রান্না করতে বলব কোন মুখে ? বাচাঁ গেল, এখন যদি রাধতে বলি বিরক্ত বোধ করলেও রাধবে।
মেহমান সঙ্গে বিধায় বধূটি আড়াল হতে সালাম দেয়। সন্তানেরাও আস্সালামু আলাইকুম বলে আমার কাছে আসে। সন্তনেরা কেমন আছে জানতে চাইলে আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছে বলে জানায়। বেশী কুশল বিনিময় না করে আনিত বাজার ভিতরে নিয়ে যেতে বলি। তারা খুশি মনে নম্র বচনে বাজার হাতে নিয়ে ধীর গতিতে চলে যায়।
বধূ ভাত পাক করে, ডিম ভেজে আমাদের খেতে দেয়। আমরা সুন্নতী কায়দায় বসে বিছমিল্লাহ বলে খুব তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিলাম। কেননা আমি গত কয়েক দিন যাবৎ শুকনা খাবার আর পানি ছাড়া কিছুই খেতে পাই নাই। আমাদের খাওয়ার ধরণ দেখে বধূটি মায়াবী দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে পলকহীন তাকিয়ে ছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। সন্তানেরাও তাই। তবে তারা মিটিমিটি নয় খিকখিক করে হাসছিল।
খাওয়া শেষে মেহমান কোন অবস্থাতেই থাকতে রাজি হলনা। চলে যায়। বধূকে একান্তে কাছে পাই। তখনও সে আমার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকায় আর আঁচল টেনে মুখ ঢেকে ছোট শব্দে হাসে। তার চাহুনীতে আমার অন্তরে প্রেম জাগ্রত হয়। এরূপ চাহুনী ও হাসির কারণ জানতে চাইলাম। সে জানালো, আজ ঘরে দানা পানি কিছুই ছিলনা। তাই ক্ষুধার যন্ত্রণায় কারোই ঘুম আসছিলনা। আপনি মেহমান নিয়ে এসেছেন, চাল ও ডিম এনেছেন কিন্তু তেল আনেন নি। ঘরে কেরোসিন ছাড়া এক ফোটাও সয়াবিন ছিলনা। নিরূপায় হয়ে কেরোসিন দ্বারাই ডিম ভেজেছিলাম। সংশয়ে ছিলাম খেতে পারবেন কিনা ? কিন্তু যখন আপনাদেরকে তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখলাম তখন অন্তরটা জুড়ায়ে গেল আর এতোটাই হাসি পাচ্ছিল তা চেঁপে রাখতে পারছিলামনা। সন্তানেরাও তা দেখে সুবহানআল্লাহ বলে হাসছিল।
বধূর একথা শুনে আমিও খিক খিক করে হাসতে হাসতে কান্নায় রত হলাম। বধূটি তার দু’হাত আমার দুই গালে আলত চেপে ধরে আমার চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। প্রিয়তমার দৃষ্টি নন্দিত চাহুনীতে নিজেকে কিছুতেই সামলে রাখতে পারলামনা। প্রেমের সমুদ্রে ডুব দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় ছেলে দু’টি ঘরে প্রবেশ করে। তারা খেয়েছে কিনা জানতে চাই।
বাবা মা সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তাঁরা কাছে থাকলে ক্ষুধা নিবারণ হয়ে যায়। তাদের অবস্থাও তাই হয়েছে বিধায় রাতে খাবেনা বলে জানায়। তাদের নীতি কায় আমার বোধদয় হয় যে, সমাজের জন্য লেখার পাশাপাশি পরিবারকেও সময় দেয়া উচিৎ। উদাসীন থাকলে কবি হওয়া যায়, মানুষ নয়। -----
আশ্চর্য ! এখনও বসে আছেন ? আমিতো ভেবেছিলাম হাতে কিছু নিয়ে ঢিল ছুড়বেন। মানেমানে কেটে পড়ি। বাকী গল্প অবস্থা বুঝে অন্যদিন বলব। আল্লাহ হাফেজ।
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪